বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে। চার দফা সময় বাড়িয়েও কাজ শেষ হচ্ছে না। এখনো ৯টি স্টেশনের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
১২০ কিলোমিটার বেগের লাইন করা হলেও সিগন্যাল সিস্টেমের কাজ বাকি থাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে ট্রেনের গতিবেগ অর্ধেকেই আটকে আছে।
বাকি কাজ শেষ করতে পঞ্চমবারের মতো সংশোধন করতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটি পাঠানো হচ্ছে।
এবার সময় বাড়ানো হচ্ছে এক বছর। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অন্য ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মতো দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
চতুর্থবার সংশোধনের মাধ্যমে আগামী ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল।
এ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু এখনো ৯টি স্টেশনের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। অন্যান্য স্টেশনের কাজও চলমান রয়েছে। সিগন্যালিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়নি। ফলে ট্রেন ধীরগতিতে চলছে। বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমও হতাশাজনক।
লট-১-এর আওতায় বৃক্ষরোপণ কাজ শুরু হয়নি। লট-২-এর রোপণ করা অধিকাংশ গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের কোনো লক্ষণ দেখা নেই। আরও কিছু কাজ বাকি রয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক সুবক্তগীন খবরের কাগজকে বলেন, ‘৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। এ পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ শতাংশ। তবে আর্থিক অগ্রগতি একটু কম, ৯৪ শতাংশ।
দৃশ্যমান কোনো কাজ বাকি নেই।’
অসম্পন্ন কাজের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যে কাজ বাকি, তা ডিফেক্ট ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের মধ্যে শেষ হয়ে হবে।
এ জন্য এক বছর সময় বাড়ানো হচ্ছে। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মহাপরিচালক (অতিরিক্ত পরিচালক) মো. জহির রায়হান যখন মে মাসে প্রকল্প পরিদর্শন করেন, তখন বাস্তবায়নের হার কম ছিল। কিছু কাজও বাকি ছিল।
এরপর বিভিন্ন স্টেশনে যে জায়গায় রং, ফিটিংয়ের কাজ বাকি ছিল, তা করা হচ্ছে। যেখানে গাছ মরে গেছে, আবার লাগানো হচ্ছে।
এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে টুকটাক কাজ আছে, তা শেষ করার জন্যই সংশোধন করে এক বছর সময় বাড়ানো হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হচ্ছে।
১২০ কিলোমিটার বেগের লাইন করা হলেও ৬০-৭০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন যাতায়াত করছে। এটা আস্তে আস্তে বাড়বে। এসব কাজ করতে মাসখানেক লাগবে।’
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ও দেশের অন্যতম পর্যটন শহর কক্সবাজারকে রেললাইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার উদ্যোগ নেয়।
এরই অংশবিশেষ ২০১০ সালের ৬ জুলাই দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি একনেক অনুমোদন করে।
তখন খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।
এর মধ্যে সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ও বিদেশি ঋণ ধরা হয়েছিল ৮১৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ডুয়েল গেজ লাইন করার জন্য প্রকল্প সংশোধন করা হয়।
২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল সংশোধন করে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ।
বাকি ৪ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে সংস্থানের সিদ্ধান্ত হয়। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজ ধরা হয়েছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ তৈরি।
এর জন্য ৩৯টি মেজর ব্রিজ, ২৩০টি মাইনর ব্রিজ বা কালভার্ট নির্মাণ, হাতি চলাচলের জন্য আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণ।
এ ছাড়া দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবং চকরিয়া, ডুলাহাজারা ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার- এই ৯টি স্থানে নতুন করে স্টেশন নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ। ১ হাজার ৩৯১ একর জমি অধিগ্রহণের কথাও উল্লেখ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্য ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের মতো এটিকেও আওতাভুক্ত করেন এবং গভীরভাবে মনিটরিংয়ের নির্দেশ দেন। তার পরও ঠিকমতো কাজে গতি আসেনি।
সংশোধন করে সময় বাড়িয়েও শেষ না হওয়ায় ২০২২ সালের ৬ জুন চতুর্থবারের মতো সংশোধন করে ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন প্যাকেজে ভাগ করে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রথম ধাপে দোহাজারী-কক্সবাজারের ১০০ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রেলপথের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে।
রামু-ঘুমধুম রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনাটি মূলত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে রুট-১-এর অংশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ট্রান্স এশিয়ান রুট-১ ভারতের গেদে থেকে দর্শনা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করবে।
এরপর ঈশ্বরদী-বঙ্গবন্ধু সেতু-জয়দেবপুর হয়ে আসবে টঙ্গী পর্যন্ত।
সেখান থেকে আখাউড়া-চট্টগ্রাম ও দোহাজারী-রামু হয়ে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে চলে যাবে মায়ানমারে। প্রস্তাবিত বাকি তিনটি ট্রান্স এশিয়ান রুটও এ রুটের সঙ্গে সংযুক্ত।
কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে রামু-ঘুমধুম অংশে ২৯ কিলোমিটার রেলপথের কাজ স্থগিত করা হয়েছে।
প্রকল্পটি আসলে ৩০ জুন শেষ হবে কি না, তা দেখার জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে সরেজমিন মনিটরিং করা হয়।
পরিদর্শনের পর প্রকল্প পরিচালক এ প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘সামান্য কিছু কাজ বাকি আছে। নির্ধারিত সময় ৩০ জুনে শেষ হবে।
তা দেখার জন্য আবারও আইএমইডির মহাপরিচালক মো. জহির রায়হান গত ১৭ মে মনিটরিং করেন।
তিনি প্রকল্পটি পরিদর্শন করে ৯টি স্টেশনের অসম্পন্ন কাজ শেষ করা, দ্রুত সিগন্যালিং কার্যক্রম সম্পন্নসহ কয়েকটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
একই সঙ্গে সব কাজ সম্পন্ন করার জন্য এক বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর সুপারিশ করেন। তা আমলে নিয়েই এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত প্রকল্পটির সময় এক বছর বাড়ানো হচ্ছে।
Posted ২:৩৯ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta